ঘটনাটি বোরহানউদ্দিন নামক এক ভদ্রলোকের,,,
তার জবানীতেই ঘটনাটি বলছি…..
আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে
(গল্পটি বলার সময় ওনার বয়স ছিল ৬৫ বছর,তিনি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা)। আমার তখন তরুন বয়স, খালাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম পাশের জেলায়। হপ্তাখানেক বেড়ানোর ইচ্ছা। কিন্তু দুদিন যেতেই আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী এক চাচা খালাবাড়ি এসে জানালেন যে আমার বাবা অসুস্থ, আমি শীঘ্রই যেন বাড়ি ফিরে যাই। এদিকে তিনি কোন একটা কাজে এসেছিলেন, তাই মা তাকে দিয়ে খবর পাঠালেন। তখন তো আর ফোনের ব্যবস্থা ছিলনা। যাহোক চাচা খবর দিয়ে চলে গেলেন আর আমি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে ভর সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাস স্টপেজে ৮/৮:৩০ নাগাদ পৌঁছে শুনলাম আজকের শেষ গাড়ি ছেড়ে গেছে একটু আগে, তখন তো এত গাড়ি ছিলনা। বেশ চিন্তিত মনে মেইনরোডের পাশে টং দোকানে বসে পড়লাম,মনে আশা হয়তো দূুপাল্লার কোন গাড়িতে হাত দেখিয়ে একটা সিট ম্যানেজ করে নিবো।
বসে বসে পায়ে ঝি ঝি লেগে গেল, কিন্তু গাড়ির আর দেখা নেই। যাও দু চারটা দেখি, সেগুলো মালবাহী ট্রাক। হাত তুলেছিলাম, থামায়নি। এক এক করে দূরের গ্রামের বাতিগুলোও নিভে গেল। সাথে পাল্লা দিয়ে আমার উদ্বিগ্নতাও বেড়ে যাচ্ছিল। টংএর কাস্টোমাররা বাড়ি ফিরে গেছে সেই কখন। এবার দোকানদারও ঝাপি ফেলতে শুরু করলো। আমায় বললো,
–ভাই,আজকের মতন ফিরে যান, এতরাত একলা এখানে কেমনে থাকবেন।
-নারে ভাই,যেভাবেই হোক আমাকে আজ বাড়ি পৌঁছাতে হবে, মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালাম।
লোকটা ঝাপি বন্ধ করে চলে গেল,,
এবার আমি একদম একা হয়ে গেলাম, কেমন যেন গা ছমছম করছিল। বসে বসে একটু ঝিমুনি লেগেছিল। হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দে ধড়মড়িয়ে উঠে একদম মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে হাত তুলে লাফাতে শুরু করলাম। ওটা ছিল একটা দূরপাল্লার বাস। আমার নাচাকুদা দেখে ড্রাইভার ব্রেক কষলো। দৌড়ে গেটে দেখলাম বাসে শুধু ড্রাইভার আর হেলপার। ওরা বাস চালানো শিখছে। ড্রাইভারের বাড়ি আমার পাশের গ্রামে হওয়ায় আমাকে ওরা বাসে তুলে নিল।
রাত তখন প্রায় বারোটা। নিশ্চিন্তে সামনের সিটে গা এলিয়ে বসে পড়লাম। মিনিট পনেরো যেতেই ড্রাইভার ব্রেক কষলো। সামনে মুখ বাড়িয়ে দেখি জন চারেক লোক একটা ছোট্ট লাশ কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
গাড়ি থামতেই ড্রাইভারকে বললো,
-ভাই,আমাদের গ্রামের গোরস্তানে বেশ পানি জমেছে,তাই এই বাচ্চাটাকে সামনের ফুলতলীর গোরস্তানে(ছদ্মনাম) নিয়ে যাব। যদি আমাদের একটু দয়া করে নামিয়ে দাও।(উল্লেখ্য ফুলতলী ঐ এলাকার বিখ্যাত,আর উঁচু কবরস্থান, সচারাচর পানি জমে না)
যাহোক ড্রাইভার ওদের তুলে নিল। গাড়িতে কিছু লাইট জ্বলছে, কিছু নেভানো।
গাড়ি চলছে।
আমরাও ঝিমাচ্ছি।
হঠাৎ কটরমটর টাইপের(কুকুর হাড় চিবালে যেমন শব্দ হয় তারচেয়ে আরেকটু জোরালো) একটা শব্দ কানে গেল,
প্রথমে মনে করলাম বাইর থেকে আসছে,পরে মনে হলো গাড়ি তো রানিং,শব্দটা গাড়ির ভিতরে।
কোন কুকুর উঠে পড়লো নাকি??
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ির মাঝ বরাবর ড্রাইভারের সামনে একটা লুকিং গ্লাস থাকে,তাতে চোখ গেল,,,যা দেখলাম,,,আজো ভুলতে পারিনা।
দেখলাম ঐ লোকগুলো বাচ্চার লাশটাকে কয়েকটুকরা করে বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে,কেউ গাড়িতে আছে কি নেই সে ব্যাপারে ওরা চিন্তিত না।
বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।এ দৃশ্য দেখে মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন।তবে মহান আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবানীতে বুকে সাহস এসে গেল,,
যত দোয়াদরুদ জানতাম সব পড়তে শুরু করলাম,
বুঝলাম পিশাচের পাল্লায় পড়েছি,
আজকে বেঁচে ফিরলে ভাববো,আমি বেশ ভাগ্যবান।
যাই হোক,ঠান্ডা মাথায় থাকতে হবে।
তাকিয়ে দেখি, হেলপার মন্ত্রমুগ্ধের মত ঐ লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে আছে,জাস্ট জমে গেছে।ড্রাইভার সামনে তাকিয়ে আছে,আল্লাহ্ কে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম আর দোয়া করছিলাম যেন সে লুকিং গ্লাসে না তাকায়,তাহলে আজকে এক্সিডেন্ট কেউ আটকাতে পারবেনা।
একলাফে ড্রাইভারের পিছনের সীটে চলে আসলাম,বসার সাথে সাথে হেলপারও লাফ দিয়ে এসে আমার পাশে বসলো,ওর শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে।
শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,,,
-খবরদার ড্রাইভারকে কিছু বলোনা,যত দোয়াদরুদ জানো সব পড়।
ওর গলার গামছাটা নিয়ে পিছনে না তাকিয়ে দাড়িয়ে লুকিং গ্লাসটা ঢেকে দিলাম।আমি চাচ্ছিলাম কোনভাবেই যেন ড্রাইভার বিষয়টা না টের পায়।ড্রাইভার ঘাড় না ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন, কি ব্যাপার?
-বললাম চোখে আলো রিফ্লেক্ট করে,
–বললো,লাইট অফ করি,
-বললাম,,লাগবেনা ভাই।।
হু বলে ড্রাইভার গাড়িতে মনযোগী হলো।রাত বলে তাকে অনেক বেশী কনসেন্ট্রেশন নিয়ে চালাতে হচ্ছে বলেই রক্ষা।
ওদিকে হেলপারের অঞ্জান হবার দশা।
সমানে আয়াতুল কুরসী পড়ছি আর একবার নিজের গায়ে,একবার হেলপারের আরেকবার ড্রাইভারের গায়ে ফুঁ দিচ্ছিলাম।
ভিতরে ভিতরে আমিও হজম হয়ে যাচ্ছিলাম।তখনও পিছন থেকে হালকা কটমট শব্দ আসছে।
গাড়ি ফুলতলী গোররস্তানে আসতেই ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিল।
আমি আগ বাড়িয়ে বললাম,ভাই নামেন,ফুলতলী চলে এসেছে।
ওরা চারজন কোলে লেগবেগে সাদা কাফনের কাপড়টা নিয়ে নেমে পড়লো,একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় ওতে কিছুই নেই।
ওরা নামতেই আমি উঠে গেট লক করে দিলাম,আর বাইরের দিকে তাকাতেই একজন বলে উঠলো,,
-বড় কোনও মুরুব্বীর দোয়া ছিল, তাই বেঁচে গেলি,,
এমন ক্রোধান্বিত সুর আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি।বাগে পেলে আমাকে মনে হয় ছিঁড়ে ফেলতো।।আর চোখ তখন টকটকে লাল,যা মানুষের চোখ হওয়া সম্ভব না।
ড্রাইভার জানতে চাইলেন গেটলক করলাম কেন?
-বললাম,ভাই, রাতবিরেতে আর কাউকে গাড়িতে উঠিও না।এদিকটা ভাল না।গাড়িটা জোরে টান।
সে আর কিছু না বলে চালাতে শুরু করলো,,
আমি কিন্তু তখনও দোয়াদরুদ পড়ছি।
অবশেষে রাত ৩ টায় গ্রামের পাশে এসে পৌঁছলাম।পাশেই ওদের গ্রাম,ওরা আর সামান্য একটু যাবে।
নামার আগে হেলপারকে নিষেধ করলাম আজ যেন ড্রাইভারকে কিছু না বলে।
তিনচার দিন পর স্থানীয় পেপারে নিউজ দেখলাম যে, রাত একটা দেড়টা নাগাদ একটা নবীস ড্রাইভার আর হেলপার সহ ফুলতলীর কিছুটা আগে একটা বাস খাদে পড়ে গেছে,দুজনের কেউ বাঁচেনি।
যে যাই বলুক আমি জানি এমনটা কেন হয়েছে।
এখনও আমাদের ঐ এলাকায় প্রায়শই গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়,,
ঐ পিশাচগুলো তো আজোও জায়গাটা ছেড়ে যায়নি,শুধু মানুষের ঘনবসতির জন্য দাপট কমিয়েছে একটু,,,,,
অনেকের পররিচিত বলে আমি জায়গাটার নাম উল্লেখ করিনি,তবে জায়গাটা রাজশাহীতে।
লেখিকাঃ নিম্মী ফারহানা